রূপকথার শহর

মো.ওসমান ফারুক অরভি

আসিফ কাল সকালে ঢাকা যাবে।আপাতত সে একাই যাবে।সব ব্যবস্থা হয়ে গেলে আসিফ তার স্ত্রী ও দুই ছেলেকেও গ্রাম থেকে নিয়ে যাবে।তবে ততদিন পর্যন্ত আসিফকে ঢাকা শহরে একাই থাকতে হবে।এসব কিছু ভেবে আসিফের মন একটু খারাপ হয়েছে বটে কিন্তু গার্মেন্টসের ১০০০০ টাকার বেতনের জন্য এতটুকু কষ্ট তো করতেই হবে।

দুপুর ২টায় আসিফ ঢাকা পৌঁছালো।ঢাকা শহরের ভিড় আসিফের কাছে বড্ড অচেনা।রাস্তায় চলার সময় বেশ কয়েকজনের সাথেই ঢাক্কা লাগল তার।সে লক্ষ্য করলো এ শহরে সবাই নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত।রাস্তায় কারোদিকে তাকানোর সময়টুকু নেই।এক বৃদ্ধ রাস্তা পার হতে পারছিল না।তবে সে বৃদ্ধের দিকে শহরের চশমা পরিহিত লোকদের চোখ যায় না।আসিফ লোকটিকে ধরে রাস্তা পার করে দিল।বড় বড় বিলাসবহুল ভবন দেখতে দেখতে আসিফ তার খালাতো ভাইয়ের বাসায় গেল।সেখানেই সে কিছুদিন থাকবে।চাকরি করে টাকা জমিয়ে তারপর বাসা ভাড়া নিয়ে তার স্ত্রী ও দুই ছেলেকে নিয়ে আসবে।তাদের দীর্ঘদিনের শখ ঢাকা আসার।

প্রথমদিন কাজে এক বিড়ম্বনায় পড়তে হলো আসিফকে।অপটু হস্তে কাপড় কাটার সময় ভুল করে বসলো আসিফ।তাতে তার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা করিম সাহেব আসিফের উপর বেশ চড়াও হলো।আসিফ করিম সাহেবের কাছ থেকে যেসব গালি শুনলো তার অনেকগুলোই সে প্রথমবার শুনছে।করিম মনে মনে ভাবতে লাগলো যে "এতো বড়ো শহরের সভ্য লোকের এমন আচরণ!" করিম সাহেবের কথাগুলো আসিফের হৃদয়ে তীরের মতো বিধল।তবে সে তার সমস্ত কাতরতা নিজের মধ্যে রেখে পুনরায় কাজে মনযোগ দিল।

রাতে বাসায় যাওয়ার আগে আসিফ বাজারে ঢুকলো।সবজির দাম দেখে তো তার চক্ষু চড়কগাছ।সে গ্রামে সবজি চাষ করতো।তাই কোন সবজি উৎপাদনে কত খরচ তা তার ভালো করেই জানা।তবে বাজারে প্রতিটা সবজির যে দাম তা সবজির উৎপাদন খরচের প্রায় তিনগুণই বলা চলে।সে ভাবতে লাগলো তাকে যদি তার সবজির সঠিক মুল্য দেওয়া হতো তাহলে হয়তো তাকে কাজের খোঁজে এ শহরে আসা লাগতো না।তবে প্রতিবাদের সুযোগ নেই।সকলে যখন পরিস্থিতি মেনে নেয় তখন সমাজের দুই একজন মানুষের প্রতিবাদ সময়ের অপচয় ব্যতীত আর কিছুই নয়।সমাজের দুই একজনের প্রতিবাদ মানুষের দৃষ্টির অন্তরালেই থেকে যায়।আসিফ সবজি ব্যবসায়ীদের মুনাফা গুনতে চেষ্টা করলো তবে সে চেষ্টা বৃথাই থেকে গেল।যার জীবন চলে গেল ১০০-২০০ টাকার হিসাব করতে করতে তার জন্য এতগুলো টাকার হিসাব বিলাসিতা ব্যতীত আর কিছুই না।

আসিফের চাকরির ২০ দিনের মাথায় আসিফের খালাতো ভাই তাকে বাসা খুঁজতে বললো।তার বাসায় নাকি তার শ্বশুর আসবে।তাই আসিফকে ২ দিনের মধ্যে নতুন ঠিকানার সন্ধান করতে হবে ।গার্মেন্টসে যেয়ে সে তার নিত্যকার কাজ করতে লাগলো।তখনই তাকে জানিয়ে দেওয়া হলো যে তার চাকরি আর নেই।"আমার চাকরির ১ মাসও তো এখনও হলো না!" তাকে বলা হলো,"কিছুই করার নাই।এখানে এমনই হয়।" মুহুর্তের মাঝে আসিফের জীবনের সকল স্বপ্ন ধূলিসাৎ হয়ে গেল।এমনিসময় তার স্ত্রীর ফোন আসলো তার কাছে।"আমাদের না এক মাস পর ঢাকা নিবা কইছিলা!কবে আমু আমরা?" "এই তো আর কয়টা দিন অপেক্ষা কর।নিয়া আমু তোমাগোরে ঢাকা।"

আসিফ রাস্তার ধারে একাকী বসে আছে।তার উপর যেন এক বিরাট বজ্রপাত নিপতিত হয়েছে।তার কি আবার গ্রামে ফিরে যাওয়া উচিত।নাকি সে এখানেই থাকবে।এখানে থেকে সে কি করবে।কিছুই তো নাই তার এখানে।তবে গ্রামেও তো তার কাজের কোনো ঠিক নেই।অন্যের জমিতে চাষ করে যা টাকা পায় তা দিয়ে তো দুই বেলার অন্নটুকুও জোটে না।

শেষমেশ আর কোনো উপায় খুঁজে না পেয়ে এক রিকশাওয়ালার সহযোগিতায় আসিফ রিকশা চালানো শুরু করে।তার জানা হয়ে গিয়েছে যে এ শহর কারো জন্য থেমে থাকে না।কারো অনাহার এ শহরের মানুষের মনে নাড়া দেয় না।কারো অসহায়ত্ব এ শহরের কাউকেই ভাবায় না।এ নির্মম বাস্তবতা হয়তো সকলে মেনে নিয়েছে নয়তো মেনে নেওয়ার ভান করছে।দুই একজন সমাজকে বদলাতে কাজ করে গেলেও তা সকলের অগোচরেই থেকে যায়।নয়তো মানুষ জোর করে তা আড়ালে রেখে দেয়।চিত্তাকর্ষণের জন্য এ শহরের মানুষের সময় আছে ঠিকই তবে ভালো উদ্যোগ নেওয়ার সময় এ শহরের মানুষ সময়হীনতায় ভুগে।

আসিফ সারাদিন রিকশা চালিয়ে রাতটা এক বস্তিতে কাটিয়ে দিচ্ছে।দিনরাত পরিশ্রম করে টাকা জমাচ্ছে।তার স্ত্রী-সন্তানকে স্বপ্নের শহরে আনতে হবে যে!