অপেক্ষা

মো.ওসমান ফারুক অরভি

সারাদিন গ্রামে গ্রামে ঘুরে বেড়ানোই সিথীর কাজ।একটুখানি দৌঁড়ালেই নাকটা লাল হয়ে যায়।খোলা চুল যখন বাতাসে উড়তে থাকে তা তখন এক রহস্যের উদ্ভব ঘটায়।তার বড় বড় চোখজোড়া যে কারো মন কেড়ে নেওয়ার ক্ষমতা রাখে।গ্রামের অনেকেই সিথীর রূপের ইন্দ্রজালে আবদ্ধ।তবে এই সতেরো বছরের মেয়ের তা সম্পর্কে কোনো খেয়ালই নেই।

রাসেদ ছিল সিথীর সবচেয়ে কাছের বন্ধু।সারাদিন দুইজন গ্রামে গ্রামে ঘুরে বেড়াত।রাসেদ গাছে উঠে সিথীর পছন্দের ফল পেড়ে আনতো আর সিথী তা পরম আনন্দের সাথে খেত।তাদের দুইজনের বন্ধুত্ব সম্পর্কে অনেকেই অনেক কিছুই বলতো।কিন্তু তা নিয়ে তাদের কোনো দুশ্চিন্তাই ছিল না।

সিথীর বয়স বাড়ার সাথে সাথে তার মা-বাবার দুশ্চিন্তাও বাড়তে লাগলো।ছেলের বয়স যতই বাড়ুক সে বিয়ে করবে নাকি না তার একান্তই তার সিদ্ধান্ত।কিন্তু মেয়ের বয়স যখন বিয়ের উপযোগী হয়ে যায় তখন মেয়ে বিয়ে করতে চায় নাকি চায় না তা তেমন কোনো গুরুত্ব বহন করে না।সিথীর ক্ষেত্রেও তেমন কোনো ব্যতিক্রম ঘটলো না।

সেথী ও রাসেদের বন্ধুত্বের খবর গ্রামের সবারই জানা ছিল।এজন্য গ্রামের কেউই সিথীকে নিজের ঘরে তুলে আনার সাহস পেল না।বিয়ের উপযোগী মেয়ের সাথে কোনো ছেলের এমন ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্ব সমাজ ভালো ভাবে দেখে না।তাদের সম্পর্কে নানা কথা গ্রামজুড়ে ছড়িয়ে পড়তে শুরু হলো।

অনেকটা বাধ্য হয়েই সিথীর মা-বাবা সিথীর সাথে রাসেদের বিয়ে ঠিক করলো।সিথী ও রাসেদ উভয়ই বেশ খুশি।কারণ তারা দুজনই অপরিচিত কারো সাথে সারা জীবন কাটানোর বিষয়টাকে সমর্থন করে না।ব্যাপক আয়োজনের সাথে তাদের বিয়ে সম্পন্ন হলো।এতটাই আনন্দের সাথে বিয়ে হলো যে বিদায়ের সময় নতুন বধূর চোখ থেকে দু ফোটা জলও পড়লো না।

বিয়ের কিছুদিন পরই সিথী ও রাসেদের মাঝে কলহের সূত্রপাত হয়।তাদের সেই বাল্যবন্ধুত্ব ধীরে ধীরে ফিকে পড়তে থাকে।আসলে স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক ও বন্ধুত্বের মাঝে তফাত রয়েছে।কিছু সময় তফাতটা সাধারণের চোখে পড়ে না।চোখে পড়ে যখন স্বামী-স্ত্রীর মাঝের নিরবতা ক্রন্দনে রূপ নেয়।

একদিন সিথী পরম স্নেহের সাথে রাসেদের জন্য তার পছন্দের খাবার রান্না করলো। "এটাকে মানুষ খাবার বলে?" "কেন,কি হয়েছে?" "খেয়ে দেখ তুমি!" সিথী তার ভুল বুঝে একগাল হাসলো।কিন্তু রাসেদের ততক্ষণে মেজাজ খারাপ হয়ে গিয়েছে।সে বাক লড়াই করল না।কিন্তু রাসেদ যে কিছুই করবে না তা ভাবলে ভুল হবে।রাসেদ সজোরে সিথীর গালে একটা থাপ্পড় বসিয়ে দিল।হয়তো এটিই তার পুরুষত্বের প্রমাণ।

এভাবেই তাদের দুজনের দিন কাটতে লাগল।কখনো নিরবতা আবার কখনো ক্রন্দন।তাদের জীবনে হাশির রেশটুকু যেন সময়ের সাথে সাথে দূরে যেতে থাকছে।এখন আর তাদের গ্রামের অলিতে গলিতে ঘুরে বেড়ানো হয় না।রাসেদের আর সিথীর জন্য গাছ থেকে ফল পাড়া হয় না।এক ঘরে থেকেও তাদের মাঝে নিরবতা দানা বেঁধেছে।একসাথে থেকেও তাদের মধ্যকার দূরত্ব ক্রমেই বেড়েই চলেছে।

রাসেদের সামান্য রোজগার দিয়ে সংসার চালানো দায়।সংসার চালাতে হলে রাসেদের প্রয়োজন রোজগার বাড়ানোর।তাই তাকে শহরের দিকে ছুটে যেতে হচ্ছে।সিথী রাসেদের কাপড় গুছিয়ে দিচ্ছে।কিন্তু কেন জানি সিথীর ইচ্ছে হচ্ছে না রাসেদকে যেতে দেওয়ার।তবে কেন?তার উত্তর সিথীর কাছে নেই।শহর যাওয়ার দিন আসলো এবং রাসেদ চলেও গেল।এক মাস পর গ্রামে এসে সিথীকে নিয়ে যাবে রাসেদ।

এক মাস থেকে দুই আর দুই থেকে তিন মাস হয়ে গেল কিন্তু রাসেদ এলো না।কোনো ফোনও আসলো না রাসেদের।সিথীর ঘরের উঠানে বসে রাসেদের অপেক্ষা করে।কিন্তু রাসেদের ছায়াটাও সিথীর সামনে আসে না।সিথীর বিশ্বাস রাসেদ একদিন নিশ্চয়ই আসবে।সিথী আজও রাসেদের অপেক্ষায় বসে আছে।রাসেদ বেঁচে আছে নাকি সে খবরটাও সিথীর শোনা হলো না।